রস
বানান বিশ্লেষণ:
র্+অ+শ্+অ
উচ্চারণ: rɔʃ
(রশ্)।
শব্দ-উৎস:
সংস্কৃত
রস>বাংলা
রস।
রূপতাত্ত্বিক
বিশ্লেষণ: √রস্
(আস্বাদন করা) +
অ (অচ্)।
পদ:
বিশেষ্য
১. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {| অর্থ | বার্তা | যোগাযোগ | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: এমন একটি বার্তা যা অপরের কাছে বিশেষ অর্থবহ হয়ে উপস্থাপিত হয়। ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে এই অর্থবহ বিশেষ বার্তাকে রস বলা হয়। মানুষের ইন্দ্রিয় দ্বারা যে সকল অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তার আস্বাদ গ্রহণ করে 'আমি'। এই বিচারে রস হলো আস্বাদনযোগ্য অনুভূতি মাত্র। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ৮ প্রকার রসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো−শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত। নাট্যশাস্ত্রের শান্তরসকে করুণ রসের অন্তর্গত বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কাব্যশাস্ত্রে ১০ প্রকার রসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রসগুলো হলো−শৃঙ্গার, বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র, শান্ত ও বাৎসল্য।
[বিস্তারিত: রস (নন্দনতত্ত্ব)]
২. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | জীবনধারা | কর্ম-কার্যক্রম | কর্ম | মনুষ্য কার্যক্রম | ঘটিত বিষয় | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: বৈষ্ণব সাহিত্যে বা সাধনায় জীবনধারাকে পাঁচটি পন্থায় ভাগ করা হয়ে থাকে। এর প্রতিটি ভাগকে রস বলে। এই পাঁচট রস হলো-শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর (উজ্জ্বল)।
৩. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | স্বাদ | সংবেদন | উপলব্ধিকরণ | মৌলিক প্রজ্ঞা প্রক্রিয়া | মানসিক কার্যক্রম | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: যা শুধু মুখবিবরের দ্বারা শনাক্ত হয়। সাধারণত খাদ্যগ্রহণের সময় যে অনুভূতি জন্য, তার বিচারে রসকে বিচার করা হয়। ভারতীয় দর্শনে এই রসকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগগুলো হলো− মধুর, অম্ল, লবণ, কটু, কষায়, তিক্ত।
৪. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {তরল দেহগত বস্তু | দেহগত বস্তু | বস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা |}
অর্থ:১. কোনো দৈহিক সত্তা থেকে নির্গত তরল বস্তু।
উদাহরণ: খেজুরের রস।
২. কোনো তরল পদার্থে দ্রবীভূত বস্তুর মিশ্র রূপ।
উদাহরণ: চিনির রস।৫. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { নিঃসরণ। তরল দেহগত বস্তু | দেহগত বস্তু | বস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: খাদ্য গ্রহণের সময় মুখের ভিতরে গ্রন্থি থেকে যে বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ নির্গত হয়।
সমার্থক শব্দবলি: রস, লালা।
৬. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { মিউকাস নিঃসরণ । নিঃসরণ। তরল দেহগত বস্তু | দেহগত বস্তু | বস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: মধ্যযুগীয় চিকিৎসাব্যবস্থায় মনে করা হতো মুখের লালা এবং পরিপাক তন্ত্র থেকে নিঃসরিত তরল পদার্থের মিশ্রণে সৃষ্ট এমন এমন একটি দ্রব্যগত দশা, যার আধিক্যে বা ঘাটতিতে দেহে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আয়ুর্বেদে এর আধিক্যকে বলা হয় রসাধিক্য।
উদাহরণ: দেহে রসাধিক্য।
৭. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { দ্রবণ | মিশ্র পদার্থ | বস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা |}
অর্থ:১. কোনো বস্তুর ভিতরে অবস্থিত নানা ধরনের দ্রব্যের দ্বারা তৈরি সঞ্চিত বা বিদ্যমান রয়েছে এমন মিশ্র তরল পদার্থ।
উদাহরণ: কোষ রস, ঘায়ের রস।
২. কোনো বস্তুর ভিতর অবস্থিত তরল উপাদান। সাধারণ এই তরল পদার্থ বলতে জলকে বুঝায়।
উদাহরণ: কাঠের রস।৭. ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | বস্তু | দৈহিক সত্তা | সত্তা |}
অর্থ: কোনো সত্তার সার বা পূর্ণ দশা।
যুক্তশব্দ:
পূর্বপদ: রসাধার।
ভারতীয় নাট্য, কাব্য ও অলঙ্কার শাস্ত্রে রসের রূপ ভিন্নতর। এই রস সৌন্দর্যবোধের একটি ভিন্নতর দশায় উপস্থাপন করা হয়। প্রত্যক্ষ স্বস্তি-অস্বস্তিবোধের সূত্রে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, তার প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের অধীন। মানুষ একে বাস্তব সত্য দিয়ে অনুভব করে। এর অবস্থান মনের উপরিতলে। এই তলে মানুষ কোনো কল্পলোক তৈরি করতে পারে না বা করে না। আর যখন তা করে, তখন সে মনজগতের দ্বিতীয় তলে প্রবেশ করে। এই তলে প্রত্যক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ের কোনো ভূমিকা নেই কিন্তু ইন্দ্রিয়বাহিত অনুভূতির প্রভাব আছে। কল্পলোকে মানুষ ভাবের নতুন জগৎ তৈরি করে। কিন্তু সেখানে বাস্তব জগতের সাথে চলে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের লক্ষ্য থাকে সত্যের কাছে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ধরা যাক, আপনার কোনো একজন প্রিয় মানুষকে কেউ প্রহার করছে। বাস্তব জগতে এই ঘটনা থেকে আপনার মনে ক্রোধ, করুণা ইত্যাদির জন্ম নেবে। কিন্তু ওই প্রিয় ব্যক্তি যদি এমন কোনো অভিনয় করে, যেখানে তাঁকে কিছুলোক প্রহার করবে। এক্ষেত্রে দর্শক প্রথমেই বাস্তব জগৎ ছেড়ে কল্পলোকে যাওয়ার মানসিকতা নিয়েই তাঁর অভিনয় দেখতে বসবে। দর্শক দেখবে প্রহারের পুরো অভিনয়টি বাস্তবের মতো হচ্ছে কিনা, কিম্বা প্রহারের কারণে প্রিয় ব্যক্তিটির অভিব্যক্তি যথাযথভাবে ফুটে উঠছে কিনা। যদি হয় তাহলে দর্শক চমৎকৃত হবেন, অভিনয়গুণের প্রশংসা করবেন। আর এর ভিতরে দিয়ে প্রিয় মানুষটি করুণা রসের সৃষ্টি করবেন। আর প্রহারকারী ব্যক্তি ক্রোধ রসটিও দান করবেন। আর যদি অভিনয়টা ঠিক না হয়, আপনার প্রিয় মানুষটি অত্যাচারিত হওয়ার পর ঠিকমতো আহাজারি না করে, তবে তা নিয়ে দর্শকের আহজারির অন্ত থাকবে না। মূলত এইভাবে বাস্তবের ঘটনা কল্পজগতে নান্দনিক হয়ে উঠে, প্রকাশের সততার সূত্রে। এই জাতীয় ঘটনায় শিশুরা বাস্তব জগত থেকে চট করে কল্পলোকে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে কেউ যদি তার মাকে মারার অভিনয় করে, তখন সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
কল্পলোকের ভাবনার সাথে বাস্তবজগতের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টার ভিতরে সামঞ্জস্য রক্ষা করাটা জরুরি। সততা এবং সামঞ্জস্যের ভিতর দিয়ে অভিনেতারা ছোটো ছোটো আনন্দ তৈরি করেন। এই সব আনন্দের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সুন্দর উপস্থাপন। আর ভিতর দিয়ে মনের গভীরে যে নানারূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং মনকে দ্রবীভূত করে, তাই হলো রস।
ভারতীয় দর্শনে নানান শাস্ত্রে নানাভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন−
কাব্যশাস্ত্রের ১০টি রস
১. শৃঙ্গার: শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামেদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার। এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই শৃঙ্গার একেই বলা হয়। প্রেমপ্রকাশ কাব্যে এই রসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
২. বীর: দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়। একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা। ভায়নক, শান্ত রস বিরোধী। যেমন−
৩. করুণ: আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলে, অকল্যাণ হলে, প্রিয়জন বিয়োগ ইত্যাদিতে এই রসের সৃষ্টি হয়। মূলত শোকের ভাব এতে প্রকাশ পায়। শৃঙ্গার এবং হাস্যরস এর বিরোধী। যেমন−বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
সুগ্রীব; "মরিব, নহে মারিব রাবণে,
এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
-মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদনকাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা− সজল আঁখি সখীরে;−
"কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
-মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন৪. রৌদ্র: ক্রোধ রস থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। এই কারণে ক্রোধকে এর স্থায়ীভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অলঙ্কার শাস্ত্রে একে রক্তবর্ণ ও রুদ্রদৈবত নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন−
"কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
-মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন৫. অদ্ভুত: আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভুত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ অলৌকিক কোনো বিষয়কে এই রসকে উজ্জীবিত করা হয়। যেমন−
"সবিস্ময়ে রঘুনাথ নদীর উপরে
হেরিলা অদ্ভুত সেতু, অগ্নিময় কভু,
কভু ঘন ধূমাবৃত, সুন্দর কভু বা
সুবর্ণে নির্ম্মিত যেন! ধাইছে সতত
সে সেতুর পানে প্রাণী লক্ষ লক্ষ কোটি
হাহাকার নাদে কেহ; কেহ বা উল্লাসে!
-মেঘনাদ বধ, অষ্টম সর্গ। মধুসূদন৬. ভয়ানক: ভয় থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, প্রকাশই ভয়ানক।
৭. বীভৎস: কোনো কুৎসিৎ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা থেকে বিভৎস রসের সৃষ্টি হয়।
৮. হাস্য: কৌতুকজনক বাক্য বা আচরণ থেকে এই রসের উদ্ভব হয়।
৯. শান্ত: চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়।
১০.বাৎসল্য: সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য রস
কখনো কখনো মনজগতের এই দ্বিতীয়তলে সৃষ্ট সৌন্দর্য শ্রোতা-দর্শকদের এতটাই গভীরে টেনে নেয়। সে তখন রসজগতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে কারণে অভিনয় দেখে মানুষ কাঁদে, হাসে, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শোনা যায় ইতালি অভিযান শেষ নেপোলিয়ানের একদল সৈন্য, লিওনার্দো দ্যা ভিন্সি যে ঘরটিতে The Last Supper ছবিটি এঁকেছিলেন, সেই ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। যিশুখ্রিষ্টের পরম ভক্তদের কেউ কেউ তখন, যিশুর সাথে প্রতারণাকারী জুডাথের উদ্দেশ্য জুতো ছুঁড়ে মারে। ফলে সে সময়ও ছবিটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মূলত এই সৈনিকরা প্রথমে মনোজগতের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে একটি রৌদ্ররস দ্বারা দ্রবীভূত হয়েছিল। এরপর এরা ছবিটির বিষয়বস্তুটির সাথে এতটাই গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল যে, তাদের কাছে ছবির জুডাথ মনের গভীরতলে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। এখানে ছবির সৌন্দর্য নিয়ে সৈনিকরা মাথা ঘামায় নি। ছবিটি নষ্ট হয়ে যাবে এই মমতাও তাদের ছিল না। এই ছবিটি ঘটনাক্রমে একদল মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল। এই কারণে এই ছবিটিকে সৌন্দর্যহীন বলা যাবে। একটি কারণে ছবিটি সৌন্দর্যের দাবিদার হয়ে উঠে। তা হলো এর সততা এবং তার সমন্বয়। ছবিটির এই সততা এবং সমন্বয় সৈনিকদের বাস্তব জগত থেকে ভুলিয়ে ঠেলে দিয়েছিল কল্পজগতে।